বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
জমি কিংবা বাড়ির মতো কোনো স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা-দখল নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকলে সেই সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে কিছু সচেতনা প্রয়োজন। নতুবা মামলা নিষ্পত্তি হলে সেই সম্পত্তি বিক্রির ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ই নানা রকম সমস্যায় পড়তে পারেন।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। রহিম মিয়া একটি জমি কিনে নিজ নামে নাম খারিজ করতঃ ভোগ দখল করে আসছেন। এমন সময় প্রতিবেশী লুৎফর ওই সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করছেন। বিষয়টি এক সময় মামলায় গড়াল। দেওয়ানি মামলা এমনিতেও বেশ সময়সাপেক্ষ, কবে মামলার সমাপ্তি ঘটবে এবং কবে তার রায় হবে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না। হঠাৎই রহিম মিয়ার টাকা-পয়সার টানা পড়েনে পরেন। তার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, বিয়েতে টাকা লাগবে। তিনি চান তার সেই সম্পত্তিটি বিক্রি করে দিতে, যেটি নিয়ে এই মুহূর্তে লুৎফরের সঙ্গে তার মামলা চলছে।
এখন প্রশ্ন হলো তিনি এই সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবেন কি-না? বিষয়টি আইনে ‘বিচারাধীন মোকদ্দমা নীতি’র আলোকে সমাধানযোগ্য। ‘বিচারাধীন মোকদ্দমা নীতি’ সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫২ ধারায় আলোচিত হয়েছে। এই নীতির মূলকথা হলো স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে মোকদ্দমা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ওই সম্পত্তি এমনভাবে হস্তান্তর করা যাবে না, যা আদালতের সম্ভাব্য ডিক্রি বা আদেশের ফলে অন্য পক্ষ যে অধিকার লাভ করতে পারে, তা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই ধারার অধীনে কোনো সম্পত্তির হস্তান্তরযোগ্যতা বাতিল হওয়ার জন্য বেশকিছু শর্ত পূরণ হতে হয়। যেমন: ১. কোনো মোকদ্দমা বা মোকদ্দমার কার্যক্রম চলমান থাকতে হবে;২. এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে মোকদ্দমা বা মোকদ্দমার কার্যক্রমটি বিচারাধীন থাকবে; ৩. মোকদ্দমা বা মোকদ্দমার কার্যক্রমটিতে স্থাবর সম্পত্তিতে অধিকার বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিচার্য বিষয় থাকবে; ৪. মোকদ্দমার কোনো পক্ষ কর্তৃক বিরোধীয় সম্পত্তি অবশ্যই হস্তান্তর করা হবে বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা হবে; ৫. সম্পত্তি হস্তান্তরটি আদালতের সম্ভাব্য ডিক্রি বা আদেশের ফলে অন্যপক্ষ যে অধিকার লাভ করতে পারে, তা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
যদি হস্তান্তরটি আদালতের সম্ভাব্য ডিক্রি বা আদেশের ফলে অন্যপক্ষ যে অধিকার লাভ করতে পারে, তা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে, তাহলে বিচারাধীন মোকদ্দমায় বিরোধীয় সম্পত্তিটি হস্তান্তর বাতিল হবে। যেমনঃ আসলামের দখলে থাকা একটি বাড়ি নিয়ে খলিল মোকদ্দমা দায়ের করল। মোকদ্দমাটি বিচারাধীন থাকাবস্থায় খলিল বাড়িটি নাসিরের কাছে বিক্রি করে দিল। মোকদ্দমায় আসলামের পক্ষে ডিক্রি এলো। এই ক্ষেত্রে খলিল কর্তৃক নাসিরের কাছে করা বিক্রিটি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং আসলাম বাড়িটির দখল নিতে পারবে। সুতরাং ক্রেতা নাসির এ ক্ষেত্রে বাড়িটি তার নিজের কাছে রাখতে পারবে না, এটি আসলামের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। কিন্তু মোকদ্দমায় যদি আসলাম ডিক্রি না পেত, তাহলে নাসিরের বরাবর খলিলের বিক্রয়টি বাতিল হতো না। কারণ এ ক্ষেত্রে বিক্রয়টি আদালতের ডিক্রির ফলে খলিল যে অধিকার অর্জন করল, তা প্রভাবিত করছে না।
তবে ৫২ ধারার অধীনে বিচারাধীন কোনো সম্পত্তি ‘সরল বিশ্বাসের কোনো ব্যক্তি’ পয়সা খরচ করে কিনে থাকলেও তার অধিকারের সুরক্ষা দেয়া হয়নি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তার ক্রয়টি বাতিল হবে এবং আদালতের রায়ে যার প্রতি অধিকারের রায় এসেছে, সেই ব্যক্তির বরাবর এই সম্পত্তি হস্তান্তরিত হবে। সুতরাং, এই নীতি থেকে এটাই স্পষ্ট যে, ক. বিচারাধীন সম্পত্তি হস্তান্তর করা হলে বিচারপরবর্তী নানা রকমের জটিলতা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের তরফেই তৈরি হতে পারে। খ. বিচারাধীন সম্পত্তি যদি কোনো ব্যক্তি অর্থ কিংবা কোনো বিনিময়ের ভিত্তিতে পান, তাহলে বিচারের পর মামলার রায় তার বিক্রেতার পক্ষে আসলে তার অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। গ. কিন্তু মামলার রায় যদি বিক্রেতার পক্ষে না এসে অন্য কারও পক্ষে যায়, সে ক্ষেত্রে ক্রেতার অধিকার নষ্ট হবে, তাকে তার জমি ফেরত দিতে হবে সেই ব্যক্তির বরাবর যার পক্ষে মামলার রায় এসেছে। ঘ. তবে ক্রেতা যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, মামলাটি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে করা হয়েছে ক্রেতাকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে, সে ক্ষেত্রে সম্পত্তিতে ক্রেতার অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮
বিস্তারিত জানতে ভিডিওটি দেখুন: